এখন বাংলাদেশ একুয়ারিষ্টের সম্মানিত সদস্যরা দলে দলে আমার বেটা কিপিঙের টেকনিকের পতাকাতলে আসতে চাচ্ছেন। সবাইকে আলাদা আলাদা করে উপদেশ না দিয়ে ভা...
এখন বাংলাদেশ একুয়ারিষ্টের সম্মানিত সদস্যরা দলে দলে আমার বেটা কিপিঙের টেকনিকের পতাকাতলে আসতে চাচ্ছেন। সবাইকে আলাদা আলাদা করে উপদেশ না দিয়ে ভাবলাম একবারে গণ উপদেশ দিয়ে দেওয়াই ভালো, কি বলেন সবাই। আসুন শুরু করা যাক।
১। প্রথমেই আপনার বেটার জন্য উপযুক্ত একটি ঘর তৈরীর পালা। প্রথমেই বলে নেই, যে যাই বলুক না কেন, গোলাকৃতির কোন জারে কোন মাছ পালাই ঠিক না। গোলাকৃতির একটা জারের কোন সীমানা থাকে না (যেটা সবাই জানেন), আর তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, গোলাকার জার এর ভেতরের বাসিন্দাদের দৃষ্টি ত্রুটীপূর্ণ দৃষ্টি হয়ে থাকে, যার ফলে মাছ স্ট্রেসড হয়ে যায় এবং ফলশ্রূতিতে মারাও যেতে পারে। বেটার ক্ষেত্রে যে ভুল ধারণাটা সবাই পোষণ করে সেটা হলো বেটার সহ্যক্ষমতা প্রচন্ড, তাই যেভাবেই রাখা হোক না কেন বেটা মহানন্দে বেঁচেবর্তে থাকবে। এই ধারণা নিয়ে বেটা পালা শুরু করে প্রথম জীবনে আমার প্রচন্ড সুন্দর ও প্রচন্ড প্রিয় কয়েকটা বেটাকে হারাতে হয়েছে আমার। ভালো ভাবে বেটা পালতে হলে নিম্নতম এক গ্যালন ধারণক্ষমতার ট্যাঙ্ক তৈরী করে নিতে হবে (৭*৭*৬ ইঞ্চি)। তবে এই সাইজের ট্যাঙ্ক নিয়ে শুরু করলে আপনি কয়েকটা সমস্যার সম্মুখীন হবেন। প্রথমত, খুব কম করে হলেও এক দিন পর পর আপনাকে ট্যাঙ্কের পানি বদলাতে হবে। ঐ ছোট্ট ট্যাঙ্কে ব্যবহার করতে পারেন এমন কোন ফিল্টার আপনি পাবেন না। আর সবচেয়ে সমস্যা হবে শীতের সময় যখন হীটার ব্যবহার না করতে পারার কারণে আপনার প্রিয় মাছগুলো আপনার চোখের সামনে অসুস্থ হয়ে মারা যাবে আর আপনি অসহায় হয়ে দেখবেন। সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিটি বেটার জন্য পাঁচ গ্যালনের ট্যাঙ্কের ব্যবস্হা করা (১৫*৮*১০ ইঞ্চি)। এই সাইজের ট্যাঙ্কে আপনার সপ্তাহে একবার ৫০-৭০% পানি পরিবর্তন করলেই চলবে, খুব সহজেই একটা ব্যাক ফিল্টার বা ছোট স্পঞ্জ ফিল্টার ব্যবহার করতে পারবেন আর প্রয়োজনের সময় সুন্দর করে একটা ছোট হীটার বসিয়ে দিতে পারবেন। চাইলে ছোটখাটো একটা প্ল্যান্টেড সেটাপও দিয়ে দিতে পারেন যেটা ছোট ট্যাঙ্কে কোনমতেই সম্ভব না।
তবে ছোট এক গ্যালনের একটা ট্যাঙ্ক হাতের কাছে রাখলে পস্তাবেন না এটা বাজী ধরে বলতে পারি। অসুস্থ বা মার খাওয়া বেটার জন্য হস্পিটাল ট্যাঙ্ক হিসেবে খুব কাজে দেবে সেটা। এছাড়াও হাতের কাছে রাখবেন কাঁচা লবন (আয়োডিন ছাড়া), শুকনো কাঠ বাদাম পাতা, শুকনো কলাপাতা আর একটা ছোট আয়না।
২। সঙ্গত কারণেই ধরে নিচ্ছি আপনি আপনার পছন্দের বেটাটা কাটাবনের কোন দোকান থেকে অথবা কোন বন্ধু বা পরিচিতের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন। তার মানে একটা মোটামুটি যুবক বা পূর্ণবয়স্ক বেটার মালিক হতে যাচ্ছেন আপনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে সঠিক বেটাটা নির্বাচন করা। কাটাবন বা অন্য যেকোন একুরিয়ামের দোকানের ক্ষেত্রে দোকান পর্যন্ত আসতে মাছগুলোকে বেশ কয়েকটা জাহান্নাম পার করে আসতে হয়, যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই বেটাগুলো বেশ দুর্বল এবং নিষ্ক্রিয় থাকে। যে বেটাটি আপনি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন সেটার শরীরের রঙ দেখুন - শরীরের রঙ যদি উজ্জ্বল ও চকচকে হয় তাহলে সেটা সুস্থ বেটা। কাঁটাবনে বেটার প্যাকেটগুলোকে সাধারণত এক জায়গাতে গাদাগাদি করে রাখা হয়, তাই আশেপাশের বেটাগুলোকে অনেকটা সময় দেখতে দেখতে বেটার ফ্লেয়ার করার প্রবণতা চলে যায়। এক্ষেত্রে আপনার পছন্দের বেটাটি যেখান থেকে নিয়েছেন তা থেকে দূরের একটি বেটার প্যাকেট নিয়ে দুটো প্যাকেট সামনাসামনি রাখুন - ফ্লেয়ার করলে খুবই ভালো, না করলেও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বেটা (বা অন্য যে কোন মাছ) নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মাছের আচার-আচরণ, চলাফেরা এবং চোখ। মাছের নড়ন-চড়ন আর চলাফেরা লক্ষ্য করুন - কোন অস্বাভাবিকতা থাকলে সেটা সম্ভবত অসুস্থতার লক্ষণ। আর সুস্থ মাছের চোখ সব সময়ে স্বচ্ছ ও পরিস্কার থাকবে - ঘোলাটে বা মলিন চোখ অসুস্থ মাছের লক্ষণ।
অনেকে মনে করেন যে বেটার বয়ামের উপর বাবল নেস্ট দেখা গেলেই সেই বেটা সুস্থ। সত্যি বলতে কি চরম অসুস্থ বেটাও বাবল নেস্ট তৈরী করতে পারে। বাবল নেস্ট তৈরী বেটার একটি জৈবিক প্রবৃত্তি যেটা নির্দেশ করে তার আধিপত্য আর প্রজনন স্পৃহা। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
৩। বেটা ঘরে আনার পর প্রথমেই মূল ট্যাঙ্কে ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। প্যাকেটে বাধা বেটার প্যাকেটসহ মূল ট্যাঙ্কে ছেড়ে দিয়ে মিনিট ত্রিশেক রাখুন যেন প্যাকেটের পানি ঘরের পানির তাপমাত্রায় আসতে পারে। এই ফাঁকে আপনি হস্পিটাল ট্যাঙ্কে এক গ্যালন পানিতে আধা চামচের একটু কম লবন দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। প্যাকেটের পানি ঘরের পানির তাপমাত্রায় এলে খুব যত্ন করে হাতে ধরে বেটাটাকে ছাড়ুন হস্পিটাল ট্যাঙ্কে। বেটা কখনোই নেট দিয়ে ধরবেন না, এতে বেটার ফিন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাঁর চেয়ে বরং সরাতে হলে আলতো করে হাত দিয়ে ধরে হাতের মুঠির ভেতর রেখে সরাবেন। হস্পিটাল ট্যাঙ্কে প্রায় মিনিট পনের রাখার পর বেটাটাকে মূল ট্যাঙ্কে ছাড়তে পারেন। পাঁচ গ্যালন পানিতে এক চা চামচ হারে কাঁচা লবন দেওয়া ভালো, এতে বেটার ইক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। যদি কেমিকেলের দোকান থেকে আসল জিনিষ কিনতে পারেন তাহলে পানিতে পরিমাণমতো মেথিলিন ব্লু আর ক্লোরিন রিমুভার ব্যবহার করতে পারেন। কাটাবন থেকে কেনা কেমিকেলগুলো দেওয়া না দেওয়া একই কথা। সব শেষে প্রতি গ্যালনে ১ বঃইঞ্চি হিসেবে এক টুকরো শুকনো কাঠ বাদামের পাতা আর এক টুকরো শুকনো কলা পাতা পানিতে ছেড়ে দিন। শুকনো কাঠ বাদামের পাতা পানিতে ট্যানিন ছাড়ে যা পানির পিএইচ নামিয়ে দেয় আর বেটার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বিভিন্নভাবে। শুকনো কলা পাতার নির্যাস বেটার ক্ষত দ্রুত সারাতে সাহায্য করে। ১২-১৫ ঘন্টা পর পানি কিছুটা লালচে হয়ে আসলে পাতা সরিয়ে নিতে পারেন।
৪। নিয়মিত খাবার হিসেবে বাজারে প্রচলিতে যে কোন মাইক্রো প্যালেট বেটাকে খাওয়ানো যেতে পারে। সাধারনত বেটাকে যত খেতে দেবেন ততই খাবে, তাই দিনে দুই বা তিন বারে প্রতিবার ৫-১০টি প্যালেট (বেটার বয়স ও শরীরের আকার হিসেবে) এর বেশী দেবেন না। বেশি খাবার মাছের জন্য ভালোর চেয়ে খারাপই করে বেশি। মাঝে মাঝে বেটাকে জীবিত খাবার যেমন টিউবিফেক্স (কাটাবনের পোকা), মশার লার্ভা, কেচো ইত্যাদি খেতে দেওয়া যায়। ট্যাঙ্কে অতিরিক্ত খাবার জমতে দেবেন না।
৫। প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা সময় আপনার বেটা ট্যাঙ্কের বাইরে এক টুকরো আয়না এমনভাবে রাখবেন যেন বেটা নিজের প্রতিফলন দেখতে পায়। নিজের প্রতিফলন দেখার পর বেটার কান্ড কারখানা দেখে মজা পাবেন কথা দিতে পারি। বেটার আসল সৌন্দর্য্য দেখা যায় ঐ সময়ে। দুটো ট্যাঙ্ক পাশাপাশি রেখে বা একই ট্যাঙ্কে দুটো বেটা ছেড়ে দিয়েও এই কাজ করতে পারেন, তবে ট্যাঙ্ক খুব ছোট না হলে প্রথমটি করা বেশ কষ্টের আর দ্বিতীয়টি দুটো বেটার স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৬। বেটা উষ্ণ পানির মাছ। ঠান্ডা পানি বা ঠান্ডা পরিবেশ বেটা সহ্য করতে পারে না। আমাদের দেশে শীতের সময়ে তাপমাত্রা খুব সহজেই ১৫-১৬ ডিগ্রী এমনকি ১০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের নিচেও নেমে যায়। সেই কারণে শীতকালে বেটার অসুখে পড়ার বা মারা যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এই বিপদ থেকে বাচতে হলে অন্তত শীতের সময় বেটা ট্যাঙ্কে হীটার ব্যবহার করার জন্য তৈরী থাকুন। ঘন ঘন তাপমাত্রার ওঠানামা বেটার জন্য ক্ষতিকর, তাই হীটার ব্যবহার করে তাপমাত্রা সব সময় ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের ওপরে রাখুন, আশা করি কোন সমস্যা হবে না।
© লেখক - সা'দ মোহাম্মদ আন্দালিব
COMMENTS